সময়কাল নিউজ
সময়কাল নিউজ

৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী স্বমহিমায় ফিরুক ছাত্রলীগ

সময়কাল ডেস্ক :
২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর। আর ২০২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর। বাংলাদেশ, স্বাধীনতা, ছাত্রলীগ-এ তিনটি নাম অবিচ্ছেদ্য।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ ছাত্রলীগ ও স্বাধীনতা-দুটি নিয়েই অনেকেই শ্লেষ্মাত্মক ও হতাশার কথা বলেন। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন ‘পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে লাভ হলো কী?’ যত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের উত্তরাধিকারই হোক না কেন, নীতি-আদর্শবিবর্জিত আখড়া বর্তমান ছাত্রলীগকে ঘৃণা করা কি ভুল?

’৯০ দশকেও ছাত্রলীগ নামে কয়েকটি ছাত্র সংগঠন থাকলেও আওয়ামী লীগের অঙ্গ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) ও জাসদের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী)-এ দুটি ছাত্রলীগ শিক্ষাঙ্গন ও ছাত্র আন্দোলনে প্রবল অবস্থানে ছিল। কিন্তু বর্তমানে সাধারণ ছাত্ররা, সাধারণ মানুষ ছাত্রলীগ বলতে আওয়ামী লীগের অঙ্গ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকেই (মুজিববাদী) চেনে। ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) প্রবল দাপটের সঙ্গে শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষাঙ্গনের বাইরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। জাসদের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী) এখন দুর্বল অবস্থায় অস্তিত্ব রক্ষা ও ঘুরে দাঁড়ানোর কষ্টকর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

ছাত্রলীগ নামে কয়েকটি ছাত্র সংগঠন থাকলেও ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) নিজেদের এতটাই বিতর্কিত করে ফেলেছে যে, ছাত্রলীগ নামটাই বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। ছাত্রলীগ নামের অন্য সংগঠনগুলোকেও এ অপবাদ নিয়ে পরিচয়ের বিভ্রান্তি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

ছাত্রজীবনে আমি ছাত্রলীগের (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী) সদস্য হিসেবে জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের (মুজিববাদী) সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম।

ছাত্রলীগের সব অংশই বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের উত্তরাধিকার। তাই বর্তমানে ছাত্রলীগ নামটা সাধারণ ছাত্র ও সাধারণ মানুষের কাছে বিতর্কিত হওয়াটা আমার জন্য খুবই পীড়াদায়ক ও কষ্টের।

আমি চাই ছাত্রলীগ নামটা সব অপবাদ ও অভিযোগ থেকে মুক্ত হোক। ছাত্রলীগ নামের সব ছাত্র সংগঠন তাদের ঘোষিত নীতি ও আদর্শের ওপর দাঁড়াক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়া ও সমর্থনে ’৬০ দশকে ছাত্রলীগ সবচেয়ে শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগকে স্বাধীনভাবে এগিয়ে চলতে উৎসাহিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু কখনোই ছাত্রলীগকে সাংগঠনিকভাবে তার পদানত, অনুগত, অন্ধ অনুসারী সংগঠন বা আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনে পরিণত করেননি। ’৬০ দশকে বহু রাজনৈতিক প্রশ্নেই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকার গুণগত পার্থক্য ছিল। ছাত্রলীগ বহু ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক অগ্রসর চিন্তার ধারক ও অগ্রসর ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল। এমনকি তৎকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় প্রকাশ্যে কৌশলগত কারণে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যেসব কথা বলা ও যেসব কাজ করার সীমাবদ্ধতা ছিল, সেসব ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ নির্ভয়ে প্রকাশ্য রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করত। ১৯৭২ সালে রাজনৈতিক আদর্শগত কারণে ছাত্রলীগ বিভক্ত হলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছাত্রলীগ তৎকালে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাসদের রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে যুক্ত হলেও কখনোই জাসদের অনুগত বা অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়নি। বরং জাসদের সঙ্গে ছাত্রলীগের (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী) সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণ দ্বান্দ্বিক। বহু ক্ষেত্রেই জাসদ নেতৃত্বের বিভ্রান্তি, আপস, সুবিধাবাদিতার বিপরীতে ছাত্রলীগ (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী) স্বাধীন ও বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করেছে।

আজ ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) সাংগঠনিকভাবেই আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুসারেই ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগের (মুজিববাদী) গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে নিুতম সব কমিটি-কাউন্সিলে কাউন্সিলরদের মতামতের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার কথা লেখা থাকলেও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে প্রায় সব পর্যায়ের কমিটি গঠনতান্ত্রিক প্রধান আওয়ামী লীগ সভাপতির ইচ্ছানুসারে গঠিত হয়ে থাকে। তাই ছাত্রলীগে এখন নামমাত্র কাউন্সিল হয়; কিন্তু কমিটি নির্বাচন হয় না। পরে ‘কমিটি দেওয়া হয়’। কখনো কখনো শুধু কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করে দেওয়া হয়। ‘দেওয়া কমিটি’র বাকি পদ পূরণ করার সুযোগ পান ‘নিযুক্ত’ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ‘দেওয়া কমিটি’র সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের বাকি পদগুলো পূরণ করতে গিয়ে পদবাণিজ্য এবং অধীনস্থ বিশ্ববিদ্যালয়, মহানগর, জেলা, কলেজ, উপজেলা কমিটি গঠন নিয়ে কমিটিবাণিজ্য, পদবাণিজ্য এখন অভিযোগের পর্যায় থেকে স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। টাকার বিনিময়ে, নানা ধরনের অনৈতিক পন্থায় কমিটি ও পদ বিক্রি হয়ে যায়। আদর্শবাদী ত্যাগীরা কমিটিতে স্থান পায় না।

ছাত্রলীগ (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী) দুর্বল হলেও এখনো পর্যন্ত গঠনতান্ত্রিক ও সাংগঠনিকভাবে জাসদের অঙ্গসংগঠন না হলেও ক্রমান্বয়ে জাসদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে নিজস্ব স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা হারাচ্ছে। ছাত্রলীগেও (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী) সদস্য ও কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে কমিটি নির্বাচন বা গঠন করার বদলে ‘কমিটি দেওয়ার কালচার’ চালু হয়েছে।

ছাত্রলীগ নামের গৌরবোজ্জ্বল, সংগ্রামী, ঐতিহ্যবাহী একটি ছাত্র সংগঠনের সাবেক সদস্য হিসেবে ছাত্রলীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমার প্রাণের চাওয়া: ছাত্রলীগ নামটা কলঙ্ক, অপবাদ, অভিযোগমুক্ত হয়ে স্বমহিমায় ফিরুক। ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) ও ছাত্রলীগ (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী) অবিভক্ত ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে ধারণ করে নিজ নিজ সংগঠনের ঘোষিত আদর্শ ও নীতির ওপর দাঁড়াক। রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দলের অনুগত, অন্ধ অনুসারী হিসেবে না থেকে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দলের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে স্বাধীন স্বকীয় ধারায় নিজেদের পরিচালিত করুক। ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) মুজিববাদের শিক্ষা ও ছাত্রলীগ (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী) বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিশ্ববীক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে পরস্পরের সঙ্গে আদর্শের প্রতিযোগিতা করুক।

আমার বিশ্বাস ছাত্রলীগের সব অংশ তাদের নিজস্ব ঘোষিত নীতি, আদর্শের ওপর স্বাধীন ও স্বকীয়ভাবে দাঁড়াতে পারলে স্বাধীনতাবিরোধীদের ‘পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে লাভ হলো কী’ বলে প্রচারণার জবাবে ৫০ বছরের শাসন-প্রশাসনে অনেক ভুল-ত্রুটির পরও আর্থসামাজিক-মানবিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ কতটা এগিয়েছে আর পাকিস্তান কতটা পিছিয়েছে তার বস্তুনিষ্ঠ জবাব দিয়ে ৫০ বছরে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অর্জনগুলো গর্বের সঙ্গে তুলে ধরতে পারবে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণে যেখানে যতটুকু ব্যত্যয় ঘটেছে, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার প্রশ্নে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব যেখানে যতটুকু আপস, পশ্চাদপসরণ করেছে সেখানে কঠোর আঘাত হেনে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় হাঁটতে বাধ্য করার স্পর্ধা দেখাবে। ছাত্রসমাজের ওপর অর্পিত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের পথে এগিয়ে যাবে।

সময়কাল নিউজ